প্রচারের শেষ দিন মাঠে আ.লীগ, বিএনপি ‘ঘরে’

ভোটের প্রচারের সুযোগ আছে আজ সকাল আটটা পর্যন্ত। তবে কার্যত গতকালই শেষ দিনের প্রচার চালিয়েছেন প্রার্থীরা। আর তিন সপ্তাহের মতো শেষ দিনেও প্রচারের চিত্র ছিল বলতে গেলে একতরফা।

নৌকার প্রার্থী আছেন এমন প্রতিটি আসনেই হাজার হাজার মানুষ মিছিল করেছে। বিপরীতে বিএনপির মিছিল বের হয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি। ঢাকায় কেবল বিএনপির নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের একটি মিছিল দেখা গেছে।

আগামী রবিবারের ভোটকে সামনে রেখে গত ১০ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর শুরু হয় আনুষ্ঠানিক প্রচার। বিএনপি-জামায়াত জোটের বর্জনের কারণে ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের চিত্র এবার পাল্টায় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর বিএনপির ভোটে আসার সিদ্ধান্তে।

প্রথমে নির্বাচন কমিশন ২৩ ডিসেম্বরকে ভোটের দিন ধরে তফসিল ঘোষণা করে। পরে বিএনপির অনুরোধে এক সপ্তাহ পেছায় ভোট। দুই জোট প্রার্থী বাছাই করে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর নানা ধাপে ৯ ডিসেম্বর চূড়ান্ত হয় প্রার্থিতা। পরদিন প্রতীক বরাদ্দের পর শুরু হয় ভোট প্রার্থনা।

রবিবার সকাল আটটা থেকে শুরু হবে ভোট গ্রহণ। আর এর ৪৮ ঘণ্টা আগে বন্ধ করতে হবে প্রচার। সেই হিসাবে আজ আটটার পর আর ভোটারদের কাছে যাওয়া যাবে না।

বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জনসংযোগে না গিয়ে তাদের সমর্থনের জানান দিতে করেছেন বিশাল বিশাল জনসভা, মিছিল, শোভাযাত্রা। নৌকার স্লোগান আর মাইকিংয়ে মুখর থাকে এলাকা।

অন্যদিকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি জোটের প্রার্থীরা বেশির ভাগই বসে ঘরে। কেউ কেউ বের হলেও তারা মূলত জনসংযোগ করেছেন। মিছিল সমাবেশ করেছেন অল্প কয়েকজন। কেউ কেউ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তারা প্রচারে বের হতে পারছেন না। কারও কারও দেখাই মেলেনি প্রচারের শেষ দিনেও।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘প্রচারণা শুরুর পর থেকেই হামলা-মামলার ভেতর থেকে আমাদের যেতে হয়েছে। শেষ বেলায় এমন হয়েছে, স্বামী ও স্ত্রী প্রচারণা চালিয়েছেন। এজেন্ট যারা হবেন, তাদের চিনে রাখার হুমকি দিচ্ছে। এর ভেতরে কীভাবে প্রচারণা চালাবেন প্রার্থীরা।’

ঢাকার চিত্র

ঢাকা-১৩ আসনে নৌকার প্রার্থী সাদেক খান কাঁটাসুরের মুক্তি সিনেমা হলের সামনে থেকে মিছিল বের করেন। এক কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ এই মিছিলে জনসমাগম ছিল চোখে পড়ার মতো। ব্যক্তিগত গাড়ি, পণ্যবাহী পরিবহন, মোটরসাইকেল এবং পায়ে হেঁটে নেতাকর্মীরা অংশ নেন মিছিলে। মিছিল থেকে সড়কে অপেক্ষমাণ সাধারণ মানুষ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে প্রচারপত্র বিলি করা হয়।

কামরাঙ্গীরচরের তুলাঘাট এলাকা থেকে মিছিল বের করেন ঢাকা-২ আসনে নৌকার প্রার্থী কামরুল ইসলাম। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডে এসে শেষ হয়।

ঢাকা-১৮ আসনে সাহারা খাতুন এবং ঢাকা-১৭ আসনে আকবর হোসেন পাঠান ফারুকের পক্ষে হয়েছে গাড়িমিছিল।

ঢাকা-৫ আসনে হাবিবুর রহমান মোল্লার পক্ষে প্রতিটি ওয়ার্ডে আলাদা সমাবেশ ও মিছিল হয়।

ঢাকা-৬ আসনে মহাজোটের প্রার্থী কাজী ফিরোজ রশীদের পক্ষে লক্ষ্মীবাজার, রায়সাহেব বাজার এলাকায় মিছিল করা হয়।

ঢাকা-৭ আসনে হাজী সেলিমের পক্ষে হয় গণসংযোগ। প্রার্থী না থাকলেও তার পক্ষে ভোট চান হাজার হাজার মানুষ।

ঢাকা-১০ আসনে শেখ ফজলে নূর তাপস ধানমন্ডি, কলাবাগান ও জিগাতলা অংশে প্রচারের পাশাপাশি মিছিল করেছেন। হাজারো মানুষের উপস্থিতি ছিল মিছিলে।

ঢাকা-১৪ আসনে আসলামুল হকের পক্ষেও বের হয় শোভাযাত্রা।

বিএনপির চিত্রটি আওয়ামী লীগের উল্টো। ঢাকায় দু-একটি আসনে জনসংযোগ এবং একটি আসনে মিছিল দেখা গেছে।

ঢাকা-৩ আসনের বিএনপির প্রার্থী গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কেরানীগঞ্জ এলাকায় মিছিল বের করেন। এতে ব্যাপক লোকসমাগম হয়।

ঢাকা-৫ আসনে নবী উল্লাহ নবীও সীমিত আকারে প্রচারণা চালিয়েছেন।

ঢাকা-১৩ আসনের আবদুস সালাম বলেন, ‘আমি গণসংযোগ করেছি। বড় ধরনের মিছিল করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু যখন শুনেছি আওয়ামী লীগের প্রার্থী মিছিল করবে, তখন সিদ্ধান্ত পাল্টেছি। কারণ দুই দল মিছিল করলে ঝামেলা হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

ঢাকা-১৪ আসনে পোলিং এজেন্টদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন বিএনপির প্রার্থী সৈয়দ আবু বকর সিদ্দিক সাজু।

ঢাকা-৪ আসনের বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমেদ পুলিশি বাধায় বের হতে পারেননি দাবি করে নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

ঢাকা-৬ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী সুব্রত চৌধুরী প্রচারে নামছেন না ঘোষণা দিয়েই। ঢাকা-৭ আসনে মোস্তফা মহসিন মন্টুও বের হননি শেষ দিনে।

ঢাকা-৮ আসনে প্রচার না চালিয়ে নিজ বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন মির্জা আব্বাস। বলেন, ‘আমার এবং আমার স্ত্রীকে পোলিং এজেন্টদের স্লিপ দেওয়া হয়নি। এ দুই আসন থেকে বিএনপির অন্তত ৮০০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।’

ঢাকার বাইরের চিত্র

সনাতনী নাগরিক সমন্বয় কমিটি আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম-৯ আসনে নৌকার প্রার্থী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। বলেন, ‘সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সব নির্বাচনে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ভোট দিয়েছেন। একাদশ নির্বাচনেও তারা মুক্তিযুদ্ধের শক্তির পক্ষেই থাকবেন।’

শেষ দিনে মিছিল-সমাবেশে উত্তাল ছিল গোপালগঞ্জের তিনটি সংসদীয় আসন। বিশেষ করে, শেখ হাসিনার গোপালগঞ্জ-৩ আসনে বের হয় দীর্ঘ মিছিল। টুঙ্গিপাড়ায় হয় বিশাল জনসভা। চিত্রজগতের নায়ক-নায়িকার উপস্থিতি ভোটারদের বাড়তি আনন্দ জুগিয়েছে।

ভোলা-১ আসনে তোফায়েল আহমেদের শেষ নির্বাচনী জনসভায় হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। বিকেল চারটায় পৌর আওয়ামী লীগ আয়োজিত সভায় তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আপনারা স্বাধীনতার প্রতীক, মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন। আমি যদি আপনাদের ভোটে আগামীতে জয়লাভ করতে পারি, তাহেল প্রতিটি ঘরে গ্যাস পৌঁছে দেব এবং ভোলাকে মনের মতো করে সাজাব।’

মাগুরা-১ আসনের নৌকার প্রার্থী সাইফুজ্জামান শিখরের পক্ষে মিছিল বের করে জেলা মহিলা লীগ। ‘নৌকা মার্কায় ভোট দিন আজীবন সেবা নিন’ স্লোগান নিয়ে শহরে মোটরযান শোভাযাত্রাও অনুষ্ঠিত হয়।

বাগেরহাট-২ (সদর-কচুয়া) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী বঙ্গবন্ধুর নাতি শেখ সারহান নাসের তন্ময়ের শেষ নির্বাচনী জনসভায় যোগ দেয় হাজারো মানুষ। গতকাল বিকেলে বাগেরহাট শহরের খানজাহান আলী ডিগ্রি কলেজ মাঠে এই জনসভায় তন্ময়ের বাবা সংসদ সদস্য ও বাগেরহাট-১ আসনের প্রার্থী শেখ হেলাল উদ্দীনও যোগ দেন।

শেখ তন্ময় বলেন, ‘আমি এখানে নেতৃত্ব দিতে আসিনি, এসেছি আপনাদের সেবা করতে। তাই আপনাদের কাছে একটাই চাওয়া, আমাকে সেবা করতে সাথে থাকার সুযোগ দিন।’

গাইবান্ধা-২ (সদর) আসনে মাহাবুব আরা বেগম গিনির নৌকার সমর্থনে গাইবান্ধা শহরে মিছিলে হাজারো মানুষ অংশ নেয়। শহরের শহীদ মিনার থেকে বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে গাইবান্ধা ইসলামিয়া হাইস্কুল মাঠে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে সভায় তিনি নৌকায় ভোট চান।

গাইবান্ধা-৫ আসনের ফজলে রাব্বী মিয়া ফুলছড়ি উপজেলা সদর কালিরবাজার নাপিতের হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জনসভা করেন।

রাজশাহী-২ আসনে সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট ও আরডিএ মার্কেট এলাকায় গণসংযোগ করেন বিএনপির মিজানুর রহমান মিনু।

অন্যদিকে বিশাল এক মিছিল করেন নৌকার প্রার্থী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা।

টাঙ্গাইল-৩ আসনে ঘাটাইলে নৌকার প্রার্থী আতাউর রহমান খানের পক্ষে নারী সমাবেশে যোগ দিয়েছেন হাজারো মানুষ। বাসস্ট্যান্ড চত্বরে সমাবেশে উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে নৌকায় ভোট চাওয়া হয়।

টাঙ্গাইল-৭ আসনে বিএনপির প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকী উপজেলার আজগান ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেন।
নাটোরের সিংড়ায় বিভিন্ন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের আয়োজনে নৌকা-বৈঠার বিশাল মিছিল হয়েছে। পাঁচ শতাধিক ভ্যান নিয়ে এই মিছিল পৌর শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।

এ সময় ‘এবারের সংগ্রাম নৌকা বিজয়ের সংগ্রাম’, ‘ওহে ভাই-কী ভাই, কে দাঁড়ায়ছে-পলক ভাই, মার্কা কী-নৌকা’ সহ নানা স্লোগানে সিংড়া শহর মুখর হয়ে ওঠে।

কিশোরগঞ্জ-২ আসনে নৌকার প্রার্থী সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বিশাল জনসভা করে তার সমর্থনের জানান দেন। পাকুন্দিয়া উপজেলা ঈদগাহ মাঠ নেতাকর্মীদের নৌকার স্লোগানে প্রকম্পিত হয়।

পটুয়াখালী-১ আসনে নৌকার প্রার্থী শাহজাহান মিয়ার সমর্থনে জেলা শহরে গণমিছিল করেন নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া মির্জাগঞ্জ উপজেলায় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বের হয় মিছিল।

কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসনে নৌকার পক্ষে ভোট চেয়ে বিশাল মিছিল বের হয়। এরপর সমাবেশে সরকারের ১০ বছরের দৃশ্যমান উন্নয়ন তুলে ধরে নৌকায় ভোট চাওয়া হয়। উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন থেকে বিভিন্ন দলের ব্যানারে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে হাজার হাজার নেতা-কর্মী সভায় অংশ নেন।